আইলা’র ক্ষতি কাটিয়ে ওঠা যায়নি ৭ বছরেও

Daily Karotoa
২৫ মে, ২০১৬ ১১:৪৫:১৯
------------------------
আজ ২৫ মে প্রলয়ঙ্করী ঘূর্ণিঝড় আইলার ৭ বছর পূর্তি। ২০০৯ সালের এই দিনে প্রলয়ঙ্করী ঘূর্ণিঝড় ও জলোচ্ছ্বাসে লণ্ডভণ্ড হয়ে যায় দক্ষিণ জনপদের উপকূলীয় অঞ্চল। এতে বেশি ক্ষতিগ্রস্ত হয় খুলনার কয়রা ও দাকোপসহ সুন্দরবন উপকূলীয় এলাকা।

দেখতে দেখতে আইলার ৭ বছর পার হচ্ছে। কিন্তু এখনও ক্ষতিগ্রস্ত অনেক পরিবার ঘুরে দাঁড়াতে পারেনি। কয়রা ও দাকোপের সাড়ে ৩ হাজার পরিবার এখনও সরকারি তহবিলের সহায়তা না পেয়ে বাঁধের ওপর বসবাস করছে। অভিশপ্ত এই দিনটির কথা মনে হলে আজও ভয়ে শিউরে ওঠেন উপকূলবাসী। কঠিন পথ পাড়ি দিয়ে দুর্যোগের সঙ্গে যুদ্ধ করে আজও টিকে আছে এ অঞ্চলের অসহায় মানুষ। আইলার কারণে কয়রা ও দাকোপ উপজেলার অনেক এলাকা এখনও প্রায় ফসলশূন্য। বিকল্প কর্মসংস্থানের কোনও ব্যবস্থা না থাকায় মানুষের অভাব অনটন বেড়েই চলেছে।  শুধু ঘর-বাড়ি নয়, ক্ষতিগ্রস্ত মানুষেরা খাদ্য, সুপেয় পানি আর চিকিৎসা সেবাসহ নানা সমস্যায় জর্জরিত।

পাউবোর আমাদীর উপ-বিভাগীয় শাখার  সাবেক কর্মকর্তা মো. আব্দুল মতিন বলেন, ঝুঁকিপূর্ণ কিছু বাঁধে মাটি দেওয়ার কাজ চলছে। তাছাড়া ভাঙন কবলিত বাঁধে ডাম্পিং ব্লক ফেলা হয়েছে। এছাড়া,ভাঙনের কবলে থাকা বাঁধগুলো মেরামতের জন্য ঊর্ধ্বতন কর্তৃপক্ষকে অবহিত করা হয়েছে।

উপজেলা নির্বাহী অফিসার মো. বদিউজ্জামান জানান, প্রাকৃতিক দুর্যোগের সময় উপকূলবাসীর আশ্রয়ের জন্য সরকারের তত্ত্বাবধানে ঘূর্ণিঝড় আশ্রয় কেন্দ্র নির্মাণের জন্য প্রস্তাব পাঠানোর বিষয়টি প্রক্রিয়াধীন রয়েছে। তিনি বলেন, উপকূলবর্তী কয়রা উপজেলাবাসীর জন্য  ২ শতাধিক আশ্রয় কেন্দ্র নির্মাণ জরুরি। আইলা বিধ্বস্ত কয়রা এলাকার মানুষের পুনর্বাসনে সরকারিভাবে সহায়তা করা হচ্ছে। কয়রাকে আইলার পূর্ব অবস্থায় ফিরে যেতে সব ধরনের সাহায্য সহযোগিতা করা হবে বলে  জানান তিনি।

কয়রা উপজেলা চেয়ারম্যান আ খ ম তমিজ উদ্দীন বলেন, ক্ষতিগ্রস্ত কয়রাকে আগের অবস্থায় ফিরিয়ে আনার জন্য সরকারের পাশাপাশি বিভিন্ন উন্নয়ন সংস্থার মাধ্যমে কার্যক্রম অব্যাহত রাখা হয়েছে।

উপকূলীয় জীবনযাত্রা ও পরিবেশ কর্মজোট (ক্লিন) -এর প্রধান নির্বাহী হাসান মেহেদী বলেন, ৭ বছর কেটে গেলেও এখনও কয়রার উত্তর বেদকাশি ও মহারাজপুর এবং দাকোপের কামারখোলা ও সুতারখালী ইউনিয়নের প্রায় সাড়ে ৩ হাজার মানুষ বেড়িবাঁধের ওপর বসবাস করছেন। আইলায় তাদের ঘর-বাড়ি, জমি-জমা সব বিলীন হয়ে গেছে নদীতে। নিজস্ব কোনও জমি না থাকায় তারা সরকারের গৃহনির্মাণ তহবিলের সহায়তা পাননি। এমনকি আজ পর্যন্ত তাদের কোনও খাস জমিও বরাদ্দ দেওয়া হয়নি। আইলার পর জরুরিভিত্তিতে যেসব বাঁধ নির্মাণ করা হয়েছিল, সেগুলো মানসম্মত না হওয়ায় জোয়ারের চাপ বা ভারী বর্ষণে বাঁধগুলো ক্ষতিগ্রস্ত হয়। গত ২১ মে খুলনায় ঘূর্ণিঝড় রোয়ানু আঘাত না হানলেও সামান্য চাপেই ৬টি স্থানে বাঁধে ফাটল দেখা দিয়েছে।

কয়রার পরিবেশবিদ আ. আজিজ বলেন, পৃথিবীর বৈশ্বিক উষ্ণায়নের ফলে জলবায়ুর পরিবর্তন ঘটছে। পরিবেশ বিপর্যয়ের কারণে বাংলাদেশ পৃথিবীর অন্যতম দুর্যোগ ঝুঁকিপূর্ণ দেশ। আর দেশের মধ্যে সবচেয়ে ঝুঁকিপূর্ণ রয়েছে দক্ষিণ উপকূলীয় বঙ্গোপসাগরের তীরবর্তী সুন্দরবন কোলঘেষা কয়রা।

উপেজলা দুর্যোগ ব্যবস্থাপনা কমিটির সদস্য সচিব উপজেলা প্রকল্প বাস্তবায়ন কর্মকর্তা প্রশান্ত কুমার রায় বলেন, দুর্যোগ মোকাবেলায় সার্বিক পরিকল্পনা ও ব্যবস্থাপনার অভাবে ঘূর্ণিঝড় ও জলোচ্ছ্বাসে প্লাবিত হওয়ার আতঙ্কে রয়েছেন উপকূলীয় অঞ্চলের প্রায় ৩ লাখ মানুষ। যে জন্য দুর্যোগে হাইরিক্স জোন হিসেবে কয়রা এলাকায় পর্যাপ্ত সাইক্লোন সেন্টারের প্রয়োজনীয়তার কথা উল্লেখ করেন তিনি।

কয়রা উপজেলা পরিষদের ভাইস চেয়ারম্যান অ্যাডভোকেট শেখ আব্দুর রশিদ জানান, কয়রাবাসী প্রাকৃতিক দুর্যোগের সময় অসহায় হয়ে পড়ে। বিশেষ করে ঝুঁকিপূর্ণ এলাকা হলো গোলখালী, জোড়শিং, আংটিহারা, ৪নং কয়রা, গোবরা, গাটাখালী, হরিণখোলা, কাটকাটা, নয়ানী, তেতুলতলার চর, পাথরখালী, হরিহরপুর, ঘড়িলাল ও হড্ডা।এসব এলাকার মানুষ দুর্যোগকালে শিক্ষা প্রতিষ্ঠান, ঘুর্ণিঝড় আশ্রয় কেন্দ্র, ধর্মীয় প্রতিষ্ঠানে আশ্রয় গ্রহণ করে থাকেন। ঘূর্ণিঝড় আশ্রয় কেন্দ্রগুলোর ধারণ ক্ষমতা অত্যন্ত কম। তিনি সরকারি প্রাথমিক ও মাদরাসাসহ বিভিন্ন শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে একটি করে আশ্রয় কেন্দ্র স্থাপনের দাবি জানিয়েছেন।

কয়রা উপজেলা প্রকৌশলী অধিদফতরের প্রকৌশলী নিরাপদ পাল জানান, প্রাকৃতিক দুর্যোগের সময় আমাদী ইউনিয়ন ছাড়া বাকি ৬টি ইউনিয়নের কপোতাক্ষ ও শাকবাড়িয়া নদী তীরবর্তী গ্রামগুলো ঝুঁকিপূর্ণ হয়ে পড়ে। তিনি বলেন, কয়রা, মহারাজপুর, মহেশ্বরীপুর, বাগালী ইউনিয়নে যে সাইক্লোন সেন্টার রয়েছে তা যথেষ্ট। কিন্তু দক্ষিণ ও উত্তর বেদকাশী ইউনিয়নে আরও সাইক্লোন সেন্টারের প্রয়োজন রয়েছে বলে তিনি মনে করেন।

দাকোপের গুনারী গ্রামের কৃষক আব্দুল মজিদ মীর জানান, আইলায় তার ঘর-বাড়ি ফসলি জমি সব কিছুই শিবসা নদীতে বিলিন হয়েছে। এখন পার্শ্ববর্তী বাঁধের ওপর পরিবার পরিজন নিয়ে মানবেতর জীবনযাপন করছি। ৭ বছর ধরে ফসলি জমিতে আমন ধান উৎপাদন করতে পারছি না। ফলে সংসারে অভাব অনটন লেগেই আছে।

আইলায় ক্ষতিগ্রস্ত মানুষেরা
সুতারখালী ইউনিয়ন পরিষদের সাবেক চেয়ারম্যান গাজী আশরাফ হোসেন বলেন, আইলার জলোচ্ছ্বাসে বিভিন্ন গ্রামের প্রায় ৭ হাজার বিঘা জমি নলিয়ান নদীগর্ভে বিলিন হয়ে গেছে। আইলার ক্ষত কাটিয়ে উঠতে না পারা মানুষ নদী ভাঙনে দিশেহারা হয়ে পড়েছে। জমিতে বালির চর পড়ে ভরাট হওয়ায় কৃষকরা ফসল ফলাতে পারছে না।

সুতারখালী ইউনিয়নের বর্তমান চেয়ারম্যান মাসুম আলী ফকির বলেন, ৭ বছরেও অনেক পরিবারকে পুনর্বাসনের আওতায় আনা সম্ভব হয়নি। এলাকার অনেক পরিবার এখনও বেড়িবাঁধের ওপর মানবেতর জীবনযাপন করছেন।

উপজেলা কৃষি কর্মকর্তা মো.মোসাদ্দেক হোসেন জানান, প্রাকৃতিক দুর্যোগে ও নদী ভাঙনের কারণে জমির পরিমাণ কমছে। আইলার আগে ১৯ হাজার ৫শ’ হেক্টর জমিতে আমন চাষাবাদ হতো। আইলায় প্রায় ২শ’ হেক্টর জমি নদী গর্ভে বিলীন হয়েছে।

ঘূর্ণিঝড় আইলার আঘাতে খুলনা, সাতক্ষীরা ও বাগেরহাট জেলার ৩৮টি পোল্ডারের সবই কমবেশি ক্ষতিগ্রস্ত হয়। ১৬৫১ কিলোমিটার বেঁড়িবাধের মধ্যে ৬৮৪ কিলোমিটার বিধ্বস্ত হয়। ৬৩৯টি স্লুইস গেটের মধ্যে ১০৯টি অকেজ হয়ে যায়। তবে আইলার পর ৩৩টি পোল্ডারের ২৫০ কিলোমিটার এলাকা মেরামত করা হয়।

সরেজমিনে দেখা গেছে, কয়রা উপজেলার দক্ষিণ বেদকাশি, উত্তর বেদকাশি, কয়রা সদর ও মহারাজপুর ইউনিয়নের পাউবোর বেড়িবাঁধের ওপর মানুষ এখনও সেই ঝুপড়ি ঘরে বসবাস করছেন। মাথা গোজার ঠাঁই না পেয়ে কষ্টের মধ্যে বেড়িবাঁধ আকড়ে আছেন তারা। আইলার পর ভেঙে যাওয়া পবনা বাঁধ, হারেজখালি, পদ্মপুকুর, শিকারিবাড়ি, পাথরখালি মেরামত হয়েছে। কিন্তু কয়রার ক্ষতিগ্রস্ত ৬টি ইউনিয়নের কপোতাক্ষ ও শাকবাড়িয়া নদীর প্রায় ৬০ কিলোমিটার বেড়িবাঁধে পর্যাপ্ত মাটি নেই। পানি উন্নয়ন বোর্ড (পাউবো) কর্তৃপক্ষ প্রয়োজনীয় মাটি দেওয়ার উদ্যোগ না নেওয়ায় বাঁধগুলো ঝুঁকির মুখে রয়েছে। দক্ষিণ বেদকাশি ইউনিয়নের আংটিহারা, খাসিটানা, জোড়শিং, মাটিয়াভাঙ্গা, উত্তর বেদকাশি ইউনিয়নের গাতিরঘেরি, গাববুনিয়া, গাজিপাড়া, কাটকাটা, কয়রা সদর ইউনিয়নের ৬নং কয়রা, ৪নং কয়রার পুরাতন লঞ্চঘাট সংলগ্ন এলাকা, ঘাটাখালি, হরিণখোলা, মহারাজপুর ইউনিয়নের উত্তর মঠবাড়ি, দশালিয়া, লোকা, মহেশ্বরীপুর ইউনিয়নের কালিবাড়ি, নয়ানি, শেখেরটেক এলাকার বেড়িবাঁধগুলো অধিকতর ঝুঁকিপূর্ণ হয়ে উঠেছে। এ সকল বাঁধ সংস্কার করা হয়নি। ফলে এসব বাঁধ ভেঙে আবারো গোটা উপজেলা লোনা পানিতে তলিয়ে যাওয়ার আশঙ্কা রয়েছে। আইলার জলোচ্ছ্বাসে খাবার পানির উৎস নষ্ট হয়ে যায়। গত ৭ বছরেও বিকল্প ব্যবস্থা না হওয়ায় বিশুদ্ধ পানির জন্য স্থানীয় জনগোষ্ঠী দারুণ কষ্টে রয়েছেন। তারা ১০/১২ কিলোমিটার পথ পায়ে হেঁটে নলকূপ থেকে পানি সংগ্রহ করছেন। পরিকল্পনা মাফিক গভীর নলকূপ স্থাপন ও পুকুর সংস্কার করে পিএসএফ স্থাপন করা যায়নি এখনও। আইলায় ক্ষতিগ্রস্ত শিক্ষা প্রতিষ্ঠানগুলোর আজও সংস্কার হয়নি। প্রায় তিন লক্ষাধিক মানুষকে দুর্যোগকালীন নিরাপদ স্থানে সরিয়ে নেওয়ার জন্য পর্যাপ্ত আশ্রয় কেন্দ্র নেই। উপজেলার অভ্যন্তরীণ রাস্তাগুলো এখনও পুরোপুরি সংস্কার সম্ভব হয়নি।

আইলা’র ক্ষতি কাটিয়ে ওঠা যায়নি ৭ বছরেও
অন্যদিকে দাকোপে ক্ষতিগ্রস্তদের এখনও পুনর্বাসনের আওতায় আনা সম্ভব হয়নি। কিছু কিছু এলাকার যাতায়াত ব্যবস্থার সামান্য উন্নতি হয়েছে। বেশির ভাগ রাস্তার বেহাল দশা। জোয়ারের চাপে পাউবোর ৩১, ৩২ ও ৩৩ নং পোল্ডারের ৩৪টি স্থানে নদী ভাঙন শুরু হয়েছে। ভাঙনকবলিত এলাকাগুলো হচ্ছে-সুতারখালী ইউনিয়নের নলিয়ান বাজার, গুনারী, সুতারখালী ফরেস্ট অফিসের পশ্চিম কোনা, কালাবগী পন্ডিত চন্দ্র স্কুল, কালিবাড়ি লঞ্চঘাট,কামারখোলা ইউনিয়নের কালিনগর টাওয়ার এলাকা, কামারখোলা, জালিয়াখালী, ভিটেভাঙ্গা, জয়নগর, তিলডাঙ্গা ইউনিয়নের কামিনিবাসিয়া পুলিশ ফাঁড়ি, মোজামনগর, আন্ধারমানিক, গড়খালী, বটবুনিয়া, বানিশান্তা ইউনিয়নের আমতলা পুলিশ ফাঁড়ি, বানিশান্তা বাজার, পতিতা পল্লী, পূর্ব ঢাংমারী বড় বাড়ি, ভোজন খালী, খেজুরিয়া, বাজুয়া ইউনিয়নের চুনকুড়ি খেয়াঘাট, কৈলাশগঞ্জ ইউনিয়নের রামনগর হাটখোলা, বুড়ির ডাবুর, পানখালী ইউনিয়নের ফেরীঘাট, খোনা, মৌখালী, পানখালী, দাকোপ ইউনিয়নের দাকোপ লঞ্চঘাট, পোদ্দারগঞ্জ বাজার, দাকোপ খেয়াঘাট (কালিনগর আড়পার) চালনা পৌরসভার নলোপাড়া থেকে চালনা বাজার পুরান জামে মসজিদ পর্যন্ত, চালনা বাজার লঞ্চঘাট থেকে পাকা ঘাট পর্যন্ত।

Popular Articles

নির্বাচনী ইশতেহারে দক্ষিণাঞ্চলের কৃষি রক্ষার বিষয়টি অন্তর্ভূক্ত করতে হবে

Video Message from Bangladesh to COP-22

Housing for Cyclone Aila affected Forest Peoples of Dacope and Koyra Upazila under Khulna Districts